নিজস্ব প্রতিবেদক:
বর্নাঢ়্যময় রাজনীতিতে ছয় দশকের বেশি সময় ধরে পার করেছেন তিনি। শেষ ১০টি বছর রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। সেই দায়িত্ব শেষে আবদুল হামিদের কাছে মনে হচ্ছে ‘মুক্ত জীবনে’ ফিরতে পেরেছেন তিনি। বঙ্গভবন ছাড়ার আগে আগে তিনি প্রকাশ করলেন সেই আনন্দ। ‘বন্দি জীবন’ শেষে ‘স্বাধীনভাবে’ চলার সুযোগ হবে, এটাই তার কাছে স্বস্তির। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত রাষ্ট্রপতি হিসেবে টানা দুটি মেয়াদ পূর্ণ করলেন আবদুল হামিদ। সোমবার শপথ নিয়েছেন নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর আবদুল হামিদকে দেওয়া হয় রাজসিক বিদায়। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে এর আগেও এসেছেন ১৫ জন। কারও বিদায় হয়েছে বেদনাবিধুর, কারও নীরবে, কারও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায়। কেউ একটি মেয়াদ শেষ করে অনাড়ম্বরে ছেড়ে গেছেন রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ বাড়িটি।
এ দিক দিয়ে ব্যতিক্রম আবদুল হামিদ,তাকে যে আড়ম্বরের সঙ্গে বিদায় দেওয়া হয়, এর আগে কখনও তা দেখা যায়নি। বেলা ১টার পর শুরু হওয়া এই বিদায় অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্টের সুসজ্জিত একটি দল বিদায়ী গার্ড অব অনার দেয় আবদুল হামিদকে। এরপর তিনি লাল গালিচায় হেঁটে গার্ড পরিদর্শন করেন। গার্ড অব অনার পর্ব শেষে আবদুল হামিদ ও তার সহধর্মিনী রাশিদা খানম ওঠেন ফুল দিয়ে সাজানো একটি খোলা জিপে। বঙ্গভবনের বক ফোয়ারা থেকে প্রতীকী কায়দায় সেই প্যারেড কারকে দুটি রশি ধরে টেনে মূল ফটকে টেনে নিয়ে যান বঙ্গভবনের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরারা। ধীর গতিতে যখন গাড়ি এগোচ্ছিল, দুই পাশ থেকে ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন বঙ্গভবনের কর্মীরা। আবদুল হামিদ হাত নেড়ে জবাব দিচ্ছিলেন অভিবাদনের। খোলা জিপটি বঙ্গভবনের মূল ফটকে পৌঁছালে আবদুল হামিদ ও রাশিদা খানম একটি কালো রঙে গাড়িতে ওঠেন।
সেখানে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সে তত্ত্বাবধায়নে মোটর শোভাযাত্রা করে তারা পৌঁছান নিকুঞ্জে তাদের বাড়ি রাষ্ট্রপতি লজে। এর আগে বেলা ১১টায় নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে শপথ পড়ান জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। সেই অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে খোলা মনে কথা বলেন আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, “আমি রিলিভড বোধ করছি। আমি খুবই আনন্দিত। ১০ বছর পরে আমি একটা মুক্ত জীবনে ফিরে যেতে পারছি। কারণ আপনার শুনেছেন, অনেক সময় আমি বলেছি- আমি একটা বন্দি জীবনে আছি। এর থেকে আমি মুক্তি পাঁচ্ছি। এখন আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি একটু ফ্রি লি মুভ করতে পারব। এটাই আমার সবেঁচেয়ে বড় আনন্দ।”
রাষ্ট্রপতির পদ কখনও উপভোগ করেননি তিনি
কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওরের মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠা আবদুল হামিদ রাজনীতি জীবনের শুরু থেকেই হয়ে উঠতে চেয়েছেন সবার প্রিয় হামিদ ভাই। তার প্রিয় এই ‘ভাই’রা কখনও তাকে নিরাশ করেননি। স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে সে সময়ের মংয়মনসিংহ-১৮ (বর্তমানে কিশোরগঞ্জ-৪) আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচন করেন। স্বাধীন দেশে আরও সাতবার ভোটে জিতে তার প্রতি আস্থা-বিশ্বাস আর ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে ডেপুটি স্পিকার এবং ২০০০ সালে তিনি হন স্পিকার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে আবার পান সংসদ পরিচালনার দায়িত্ব। ২০১৩ সালে সে সময়ের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান অসুস্থ হলে প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তিনি মারা গেলে ওই বছরের ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন আবদুল হামিদ। ১০ বছর পর এই ২৪ এপ্রিলই মেয়াদ শেষে বঙ্গভবন ছেড়ে তিনি উঠলেন ঢাকায় তার আপন নিবাস নিকুঞ্জ-১ আবাসিক এলাকার বাড়িতে।
২০০০ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে তিন কাঠার জমিটি বরাদ্দ পেয়েছিলেন তিনি। কয়েক বছর পর সেখানে তোলা হয় তিন তলা বাড়িটি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবদুল হামিদ বলেছিলেন, এই দায়িত্ব তিনি উপভোগ করেন না। “খাঁচার পাখিরে যতই ভালো খাবার দেয়া হোক, সে তো আর বনের পাখি না। আমি একটা দায়িত্ব হিসেবে এখানে এসেছি। সংসদে মনের খোরাক পেতাম, বঙ্গভবনে পাই না। মনটা অনেক কিছু চায়।” তার কী মন চায়, সে কথাও স্পষ্ট করেন সেদিন। বলেন, “ইচ্ছা করলেই অনেক কিছুই করতে পারি না। আর ইচ্ছে করতেও তো অনেক সমস্যা। আসলে বেশি পলিটিক্যাল মানুষের জন্য, মানে গ্রাসরুটে রাজনীতি করা মানুষের জন্য এ জায়গাটা সব সময় আরামদায়ক হবে বলে মনে হয় না। “যারা ফ্রিলি মানুষের সঙ্গে মেশে না, তাদের কথা আলাদা।
এখানে বেশিরভাগই ছিলেন বিচারপতি-শিক্ষক। ওঁরা তো বেশি মানুষের সঙ্গে মেশেন না।”বঙ্গভবন থেকে বিদায়বেলাতেও সেই কথারই যেন পুনরাবৃত্তি ফুটে উঠেছে বিদায়ী রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে। নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠান শেষে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে বলেন, “আমি স্পিকার ছিলাম। এখানে আসার ইচ্ছে ছিল না, আমি এসেছি আরকি। আমি পার্লামেন্টে বেশি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। ওখানে নিজেকে মুক্ত মনে হত। “আমি জানতাম, এখানে (বঙ্গভবনে) আসলে অনেকটা বেড়াজালের মধ্যে পড়ে যাব। যাই হোক, তবুও ১০ বছর পর করে ফেলেছি।” সাংবাদিকদেরকে তার কাছে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, “আসবেন সময়ে সময়ে প্রাণ খুলে মন খুলে আলোচনা করব।”
আর রাজনীতি নয়
রাজনীতিতে হাতেখড়ি সেই ১৯৫৯ সালে। ১০ বছর রাষ্ট্রপতি থাকার পর এখন কী করবে, আবার কি রাজনীতিতে ফিরবেন তিনি? আবদুল হামিদ বললেন, “আর না।” তিনি বলেন, “রাজনীতি করা, এটা আমার পরিকল্পনায় নেই। দেশের মানুষ আমাকে এত বড় ইজ্জত দিয়ে মন খুলে দুই মেয়াদে তারা আমাকে রাষ্ট্রপতি করেছে। সুতরাং আবার আমি রাজনীতি করব, আবার অন্য কোনো পদে যাব- এসব করলে আমার মনে হয় এ দেশের মানুষকে আমি হেয় করব। সেটা আমি করব না।” বাকি জীবন কী করবেন, সে প্রশ্নের জবাব দিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, “আমি তো রিটায়ার্ড হয়ে গেছি। রিটায়ার্ড মানে- দোজ হু আর টায়ার্ড। বাড়ি বসে লেখালেখি করতে পারি।”
রাজনীতিকদের প্রতি পরামর্শ
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তরুণ রাজনীতিকদের প্রতি নিজের পরামর্শও তুলে ধরেন আবদুল হামিদ। নিজের রাজনৈতিক জীবনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সারাজীবন রাজনীতি মানুষের জন্য করেছি। মানুষের বাইরে আর কোনো চিন্তা ছিল না, থাকবেও না। “সকল রাজনীতিবিদদের এ কথাই বলব, দেশের মাটি ও মানুষের কথা ভেবে যেন রাজনীতি করে। তাহলে রাজনীতি অনেক সুন্দর হবে। সেটাই দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে আশা করি।” তিনি বলেন, “নতুন রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক দায়িত্ব সুষ্ঠু ও সন্দরভাবে পালন করবেন, এটাই জাতির প্রত্যাশা।”
সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ্।
বঙ্গভবন ছেড়ে নিকুঞ্জে পৌঁছে রাষ্ট্রপতি লজে প্রবেশের আগে উপস্থিত সংবাদিকদের সঙ্গে আরেক দফা কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন আবদুল হামিদ। রোদের মধ্যে কষ্ট করে গাড়ি বহরের পিছু পিছু আসায় সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি। “আপনাদের অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আজকের দিনে আমার যেটুকু সফলতা, এজন্য পুরো দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার প্রতি দেশবাসীর দোয়া ছিল। আমার জেলা, আমার এলাকার মানুষেরও দোয়া ছিল আমার প্রতি। বিশেষ করে আপনাদের (গণমাধ্যম) প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।” তিনি বলেন, “বিভিন্ন সময় আমি যা-ই বলেছি, টুইস্ট না করে তা আপনারা প্রকাশ করে মানুষের মধ্যে তুলে ধরেছেন, এ জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তাছাড়া আজকে আমি এটাও বলতে চাই- মাননীয় প্রধানমনন্ত্রী আমাকে মোটামুটি ফ্রিলি কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন, বা আমার কাজের ব্যাপারে কোনোরকম বাধার সৃষ্টি হয়নি; এ জন্যে তার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”
বেশি সময় দেবেন হাওরে
নিজের ভাষায় ‘অবসরে যাওয়া’ আবদুল হামিদের আগামী দিনগুলো কীভাবে কাটবে, সেই আভাসও তিনি দেন। ভাটির শার্দুল খ্যাত এ রাজনীতিক বলেন, “আমার বেশিভাগ ইচ্ছে হাওর এলাকায় থাকার। ঢাকায়ও থাকতে হবে। আমার রাজনীতির চারণভূমি কিশোরগঞ্জেও সময় দেব। “সময়টাকে আমি তিনটা ভাগে ভাগ করতে চাই- ঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও আমার হাওর এলাকা। চেষ্টা করব হাওর এলাকায় বেশি থাকার।” গণমাধ্যমের প্রতি আবারও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার যেটুকু জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্য রয়েছে, অর্জন রয়েছে, তাতে মিডিয়ার একটা অনন্য অবদান অস্বীকার করতে পারব না। এ জন্যে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা।”
‘সুষ্ঠু রাজনীতি অবশ্যই আসবে’
আবদুল হামিদ বলেন, “আপনার আমাকে ভালোবাসেন,আমার মতো একজন সাধারণ মানুষ,যদিও রাষ্ট্রপতি হয়েছি, তবুও আমি নিজেকে এদেশের একজন সাধারণ মানুষ মনে করি।”
ছয় দশকের রাজনৈতিক জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে তিনি বলেন, “আমি সারাজীবন রাজনীতি করেছি, সেটা এদেশের মানুষের কল্যাণের চিন্তা করে। আমি চেষ্টা করেছি, আমার ক্ষুদ্র ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করেছি এদেশের সুষ্ঠু রাজনীতি প্রবর্তন করা যায়। সেটায় সফল হয়েছি এ কথা বলতে পারব না, তবে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।” ভবিষ্যতে দেশে সেই ‘সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা’ দেখার প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, “আমি আশা করি অদূর ভবিষ্যতে দেশে একটা সুষ্ঠু, স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকবে। বিরাজ করবে। একটা সুষ্ঠু রাজনীতি অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হবে। “এর মাধ্যমে এ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে. আরও এগিয়ে যাবে। এ দেশের মানুষের কল্যাণ চাই,ভালো চাই। সুখে থাক। সকল দিক থেকে এ দেশের মানুষ ভালো থাক।”