প্রতিনিয়তই বেড়েই চলেছেঅবৈধ ইটভাটার সংখ্যা । পরিবেশ অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করলেও সেগুলো আবার চালু হয়ে গেছে। দেশে চালু অর্ধেকের বেশি ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই, চলছে ইটভাটা আইন অমান্য করে। ইটভাটা দেশের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। একই সঙ্গে তা কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির ক্ষতি করছে। এইসব ইটভাটার কারণে প্রতিনিয়ত বায়ূ দূষণ হচ্ছে। ইটভাটা থেকে নির্গত ছাই পার্শ্ববর্তী নদী বা জলাশয়ে নিষ্কাশিত হয়। ওই বর্জ্য পানিতে মিশে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত উপাদান যেমন- লেড, ক্যাডমিয়াম, জিংক ও ক্রোমিয়াম জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মাধ্যমে খাদ্যশৃঙ্খলের দ্বারা মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। ফলে মানুষ বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্খিত জটিল রোগের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৩৭ হাজার মানুষ মারা যায়, যাদের বয়সের গড় মাত্র ৩৮ বছর। সংস্থাটির ২০১৮ সালের এক গবেষণায় ঢাকাকে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ দূষিত শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের সব বড় শহরের দূষণচিত্র প্রায় একই রকম। গ্রামাঞ্চলের অবস্থাও ভালো নেই। ২০২০ সালে পরিবেশ ও বায়ুর মান ভালো করার লক্ষ্যে পাঁচ জেলার অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ১৫ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত।
তার পর এই পাঁচ জেলায় অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান জোরালো করা হয়। তবে বেশ কিছু যায়গা ঘুরে দেখা যায়, হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে সকাল-সন্ধ্যা অবৈধ ভাটাগুলোতে চলছে ইট তৈরি ও পোড়ানোর কাজ। কয়লার পাশাপাশি এসব ভাটায় ব্যবহার হচ্ছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কাঠের গুঁড়া। এতে বায়ুর পাশাপাশি ফসলি জমিরও ক্ষতি হচ্ছে। আইন না মেনেও, দিনের পর দিন টিকে আছে অসংখ্য ইটভাটা ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে এমন ভাঁটা আছে প্রায় ৪ হাজার। কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে, মালিকরা আইন ফাঁকির সুযোগ পান বলে স্বীকার করছে অধিদপ্তর। তবে এদের ঠেকাতে কি ব্যবস্থা, তা স্পষ্ট করেননি কর্মকর্তারা। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে মোট ৭ হাজার ৮৬টি ইটভাটা চালু আছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০৫ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব ইটভাটায় বছরে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ইট তৈরি হচ্ছে। এসব ইটভাটার বছরে ১৩ কোটি মেট্রিক টন মাটি লাগে। পোড়া ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব ব্লক নির্মাণ শুরু হয়েছে দেশে। ভবনে পাঁচটি ইটের বিপরীতে ১টি ব্লক যথেষ্ট। আর সড়কে প্রতিটি ইটের সমান আয়তনের হবে ব্লকগুলো।
সে হিসাবে ভবন নির্মাণে ইটের চাহিদা পূরণে বছরে ১৮০ কোটি ব্লক দরকার। আর সড়কের উন্নয়ন কাজে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি ব্লক দরকার। ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে বলা হয়, সারা দেশে ইটভাটা ছিল ৪ হাজার ৯৫৯টি। আর ২০১৮ সালে এ প্রতিষ্ঠানটিই জানায়, দেশে ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯০২টি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইট প্রস্তুত মালিক সমিতির তথ্যমতে, দেশের বিদ্যমান ইটভাটাগুলোর মধ্যে অন্তত ৪০ ভাগের কোনো বৈধতা নেই। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩-এ বলা হয়েছে, বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা করা যাবে না। কৃষিজমিতেও ইটভাটা অবৈধ। অথচ দেশের প্রায় শতভাগ ইটভাটা এই আইন মানছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ইটভাটাগুলোয় বছরে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি ইট প্রস্তুত হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৭০০ কোটি ইট ভবন ও সড়ক উন্নয়নে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ৯০০ কোটি ইট ব্যবহৃত হচ্ছে ভবন নির্মাণে এবং সড়কে ব্যবহৃত হচ্ছে অন্তত ৮০০ কোটি ইট। এ ছাড়া প্রায় ৮০০ কোটি ইট পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও রপ্তানি করা হয়।
হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশের ইটভাটাগুলোয় প্রতিবছর ২০ লাখ টন জ্বালানি কাঠ এবং ২০ লাখ টন কয়লা পোড়ানো হয়। তাদের হিসাবে এ থেকে বছরে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হয় প্রায় ৯০ লাখ টন। এ প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা মনে করেন, দেশে পোড়া ইটের কোনো প্রয়োজন নেই। নদী থেকে ড্রেজিং করে যে বালু ও মাটি উত্তোলন হয়, তা দিয়েই পোড়া ইটের বিকল্প ব্লকের চাহিদা শতভাগ পূরণ করা সম্ভব। একাধিক অবৈধ ভাটার মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ‘প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই অবৈধ ভাঁটা চালিয়ে আসছি। ম্যানেজ না হলে অবৈধ ভাঁটা এক দিনও চলতে পারবে না। ভাটার মালিক ও প্রশাসনের যোগসাজশে এটা সম্ভব হয়েছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর এ বিষয়ে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। সারাদেশে ১০ হাজারেরও অধিক ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪ হাজারই অবৈধ। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধভাবে এসব ভাটায় ইট পোড়ানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা- কর্মচারীর যোগসাজশে এসব অবৈধ ইটভাটা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।