ব্রিঃজেঃ(অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে দেশের প্রথম মেট্রোরেল বাণিজ্যিক ভাবে যাত্রা শুরু করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান বিজয়ের মাসে এই মেগা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন। এই মেট্রোরেল চালু হলে রাজধানী শহর ঢাকায় যানজট কিছুটা হলেও কমবে বলে আশা করা যায়। সে সাথে বর্তমান গণপরিবহন ব্যবস্থায় ও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। বিশ্বের অনেক বড় বড় শহরে মেট্রোরেল গণপরিবহণের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। মেট্রোরেল যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরাপদ ও মানুষ নিশ্চিতে সময়মত এটা ব্যবহার করতে পারে। এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে জাপান ১৯২৭ সালে প্রথম পাতাল রেলব্যবস্থা তৈরি করে। ভারত ১৯৭২ সালে কলকাতায় মেট্রো সিস্টেম নির্মাণ শুরু করে এবং পরে ভারতের আরও কয়েকটা শহরে মেট্রোরেল ব্যবস্থা চালু হয়। বর্তমানে, বিশ্বের ৫৬টি দেশের ১৭৮টি শহরে ১৮০টি পাতাল রেলব্যবস্থা চালু রয়েছে।
২০১২ সালে বাংলাদেশ মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সে বছর ডিসেম্বর মাসে, ‘ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ বা ‘মেট্রোরেল’ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দ্বারা অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের জন্য মোট ৫টি রুট প্রস্তাব করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে এমআরটি লাইন ১, ২, ৪, ৫, এবং ৬। ঢাকা মেট্রো রেল, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় গণপরিবহণের জন্য জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)এর অর্থায়নে চলমান একটি সরকারি প্রকল্প। প্রকল্পটি পরিচালনা করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুন ২০১৬ সালে মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের সূচনা করেন। প্রাথমিক ভাবে এমআরটি লাইন-৬ দিয়ে মেট্রোরেল চলবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এমআরটি লাইন ৬-এর দৈর্ঘ্য ছিল ২০.১ কিলোমিটার, পরে তা কমলাপুর পর্যন্ত বাড়ানো হয়, ফলে রুটটির দৈর্ঘ্য আরও ১.১৬ কিলোমিটার বেড়ে এর মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ২১.২৬ কিমি. এবং এই রুটে মোট ১৭টি স্টেশন থাকবে ও ২৪টি ট্রেন সেট চলবে। বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে যেতে প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে সময় লাগবে ৪০ মিনিট। প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু হলে শুরুতে দিনে ৪ লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে এবং আশা করা যায় ২০৩৫ সাল নাগাদ যাত্রীসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ লাখের বেশি।
এমআরটি লাইন ১ মেট্রো রেল প্রকল্পের অধীনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রুট। এমআরটি লাইন ১, দুটি ভিন্ন রুটে নির্মিত হবে। ‘এয়ারপোর্ট রেল লিংক’ লাইনটি কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত যাবে,এ রুটটিতে ভূগর্ভস্থ স্টেশনও থাকবে। এই লাইনের দ্বিতীয় রুটটি বারিধারা থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত যাবে যা পূর্বাচল রুট নামে পরিচিত হবে। এমআরটি লাইন ১-এর দুটি রুটই ২০২৬ সালে নির্মাণ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এমআরটি লাইন ৪, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত যাবে এবং এর নির্মাণ কাজ ২০৩০ সালে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এমআরটি লাইন ২ গাবতলী থেকে চিটাগং রোড পর্যন্ত চলবে এবং ২০৩০ সালে নির্মাণ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০১৮ সালে বুয়েট পরিচালিত এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে ঢাকায় যানবাহনের গতিবেগ গড়ে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার যা হাঁটার গতির সমান। এই গতি যানজট সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকার ফলে যাত্রীরা মানসিক চাপের শিকার হয় যা পরোক্ষ ভাবে বিভিন্ন রোগের উৎস হিসেবে কাজ করে। যানজটের কারণে ঢাকা শহরে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এই ক্ষয়ক্ষতি থেকে উত্তরন ও একটি আধুনিক পরিবহন বান্ধব শহর গড়ার লক্ষ্যে ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ২০২৪ সালের মধ্যে তিনটি এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি পথে মেট্রোরেল চালুর সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ এর কাজ চলমান এবং এমাসেই জনগণ এই লাইন থেকে আংশিক সুবিধা পাবে। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড থেকে জানা যায় যে, ঢাকায় আরও তিনটি মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। সব লাইন যখন চালু হবে তখন রাজধানীবাসী এই প্রকল্পের সুফল পুরোপুরি ভাবে পাবে ।
আশা করা যায় যে,এমআরটি লাইন-৬ চালু হলে এই রুটের নিচের রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কিছুটা কমবে। যারা সিএনজি অটোরিকশা বা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে তারা মেট্রো ব্যবহার করতে আগ্রহী হলে রাস্তাগুলোতে ছোট গাড়ির সংখ্যা কমে যাবে এবং কিছুটা হলেও যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে। মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোতে যাত্রীদের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক সব সুবিধা। এই মেট্রোরেল প্রকল্পটি কর্মঘণ্টা ও যানজট কমানোর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশা প্রকাশ করেছেন। প্রকল্পটি রেল বেজড হওয়ায় এটি নিরবচ্ছিন্নভাবে চলাচল করবে এর ফলে যাত্রীদের ভ্রমণে সময় কম লাগবে। গন্তব্যে পৌঁছাতে কতটা সময় লাগবে তা আগে থেকে জানা থাকবে বলে যাত্রীরা সময়মত স্টেশনে পৌঁছে গেলে সহজেই তার গন্তব্যে হাজির হতে পারবেন। আগে থেকে ভ্রমনের সময় জানা থাকার ফলে অনেক কর্মঘণ্টা বেঁচে যাবে যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।
জাপানি প্রতিষ্ঠান এর নির্মাণে জড়িত এবং পরামর্শক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছে। জাপান বহু বছর এই মেট্রোরেল পরিচালনা করছে, টোকিও’র মেট্রোরেল অফিসের সময় প্রচণ্ড ভিড় থাকে এবং অফিসগামী মানুষ সেটা সাচ্ছন্দে ব্যবহার করে। তাদের কোনো ধরনের দুর্ঘটনার রেকর্ড নেই। আমাদের দেশেও জাপানের প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এই মেট্রোরেল পরিচালনা করা হবে। অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারের (ওসিসি) মাধ্যমে পুরো সিস্টেমটা পরিচালিত হবে। এতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি,মুভিং ব্লক কমিউনেকশন বেজড টেলিকন্ট্রোল সিস্টেম এবং অটোমেটিক ট্রেন অপারেশন বা এটিও থাকবে। ট্রেনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সেন্ট্রাল কন্ট্রোল থেকেই নিয়ন্ত্রিত হবে। ট্রেন অটোমেটিক স্টপ কন্ট্রোলের মাধ্যমে কোথায়, কখন থামাতে হবে সেটি নির্ধারিত হবে এবং এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করার কারনে চালকের বেশী কিছু করার থাকবে না। প্রোগ্রাম রুট কন্ট্রোলার সিস্টেমের মাধ্যমে ট্রেনের রুটগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
এসব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে মেট্রোরেল পরিচালনায় তেমন কোনো সমস্যা হবে না।
বাংলাদেশের মতো একটি ছোট এবং জনবহুল দেশ মেট্রোরেল প্রকল্প থেকে অনেক সুবিধা পেতে পারে। মেট্রোরেল প্রতিদিনের যাতায়াতের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনার পাশাপাশি একসঙ্গে প্রচুর সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে চলমান অন্যান্য পরিবহনের মাধ্যমগুলোর ওপরও চাপ কমিয়ে দেবে। এর ফলে বর্তমান যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হবে। দেশের যোগাযোগ ও পরিবহন খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বাংলাদেশ যোগাযোগ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন যুগে প্রবেশ করবে। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর সুফল মানুষ পেতে শুরু করেছে, বাকী প্রকল্পগুলোর সুফল সামনের দিনগুলোতে পাওয়া যাবে।
মেট্রোরেল চালু হলে যোগাযোগে স্বাধীনতা আসবে, অর্থনীতির গতি বাড়াবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। মেট্রো রেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে গতিশীল করবে এবং অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।মেট্রো রেল পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচুর লোকবল লাগবে এবং এই প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক কর্মসংস্থান হবে যা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। মেট্রো রেলের কারনে বিদ্যমান গণপরিবহণ ব্যবহারে নারীদের যে অনীহা আছে তা দূর হবে ফলে তারা মেট্রো রেলে ভ্রমণে আগ্রহী হবে ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে। মেট্রোরেল চালু হলে এই সুবিধা ব্যবহার করে ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব কমার সম্ভাবনা রয়েছে, এর পাশাপাশি যানবাহনের সংখ্যা কমলে পরিবেশ দূষণ কমাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে। বিশ্বব্যাংক, বুয়েট এবং বিভিন্ন সংস্থা মেট্রোরেল প্রকল্পের নানা দিক নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে। সেসব তথ্য উপাত্ত অনুসারে জানা যায় যে, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ফলে ফলে বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলে বাংলাদেশ ২.৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে। মেট্রো রেল প্রকল্পটি প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে যা জিডিপির ১.৫ শতাংশের সমান।
বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থায় ঢাকার মেট্রোরেল এক নতুন যুগের সূচনা করেছে।দেশের পরিবহন খাতের জন্য এটা একটা বড় ঘটনা। আশা করা যায় যে এ ধরনের পরিবহণ মানুষের জীবনধারা পরিবর্তন এবং তাদের উৎপাদনশীল সময় বৃদ্ধি করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মেট্রোরেল বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় স্বপ্ন প্রকল্প, এর বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। উন্নয়নের ধারবাহিকতায় বাংলাদেশ পৃথিবীর মেট্রোরেল ব্যবহারকারী দেশগুলোর কাতারে যোগ দিতে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব, সময় সাশ্রয়ী, আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর এই প্রকল্প বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে পরিবহনখাতে সুদূরপ্রসারী ভুমিকা রাখবে এটাই প্রত্যাশা।
ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন,এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি,এম ফিল,
গবেষক ও কলামিস্ট