রোজা আসার আগেই নিত্যপণ্য সব জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। দিন দিন তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মূলত অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ওই চক্রটি নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। সরকার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও সব সময় থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে চক্রের প্রভাবশালীরা।
নিত্যপণ্যের বাজারে অতি মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সবাই মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। কিন্তু ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ পণ্যের ঘাটতি না থাকলেও ব্যবস্থাপনার ঘাটতি তীব্র। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কোনো অজুহাত ছাড়াই রোজা এলে প্রতিবছরই বাজার ঘিরে একশ্রেণির ব্যবসায়ী নানা ধরনের অপতৎপরতা শুরু করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। যদিও পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতোমধ্যে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাকে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও যৌথভাবে মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীও ভোগ্যপণ্যের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীকে ডেকে রোজার বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে খুচরা ও পাইকারি বাজার ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা, মিল মালিক, আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ীদের ডেকে নিয়ে এক ধরনের সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে। বাজার ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশন নেতাদেরও পরিষ্কার বার্তা দেয়া হয়েছে।
বলা হয়েছে, মূল্য কারসাজি ধরা পড়লে বিলুপ্ত করা হবে সংশ্লিষ্ট বাজার কমিটি। সূত্র জানায়, আসন্ন রোজায় প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন ভোজ্যতেল,৩ লাখ মেট্রিক টন চিনি,১ লাখ টন ছোলা, প্রায় ৫০ হাজার টন খেজুর, প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন মসুর ডাল এবং৪ লাখ টন পেঁয়াজ চাহিদা রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দাবি, রোজার চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পণ্য আমদানি হয়েছে।
কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এখন অনেক পণ্যের মূল্য বেশি। অনেক পণ্যের সঙ্কটও রয়েছে। বিশেষ করে চিনির সঙ্কট কাটছে না। সেক্ষেত্রে খুচরা বিক্রেতাদের বক্তব্য, মিলগেট ও পাইকারি বাজার থেকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। নজরদারি সেখানে ঠিক রাখলে রোজার বাজারে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিগত ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে দেশে ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৫৭৪ মেট্রিক টন চিনি আমদানি হলেও ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৯ লাখ ৪১ হাজার ৫১৯ টন। এ সময়ে ৭ লাখ ৭ হাজার টন চিনি আমদানি কমেছে। ফলে রোজার আগেই উত্তপ্ত চিনির বাজার। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আমদানি পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫ শতাংশ কমিয়েছে।
পাশাপাশি টনপ্রতি অপরিশোধিত চিনিতে ৩ হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনিতে ৬ হাজার টাকা আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। সূত্র আরো জানায়, গত জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ১৮৩ মেট্রিক টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়। আগের বছরে একই সময়ে ওই আমদানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮৮ টন। এ সময় ১ লাখ ৬১ হাজার ৬৯৫ টন বেশি আমদানি হয়েছে।
২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর পাম অয়েল আমদানি হয় ৬ লাখ ৪ হাজার ৬০ মেট্রিক টন এবং ২০২১ সালের একই সময়ে ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৮০৩ মেট্রিক টন আমদানি হয়েছে। এ সময়ে আমদানি বেড়েছে ৬৭ হাজার ২৫৭ টন। তাছাড়া মসুর ডাল গত ৬ মাসে প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার টন আমদানি হয়েছে। আগের বছর একই সময়ে ১ লাখ ৯ হাজার ২০১ টন আমদানি হয়েছিল। ফলে এবার তুলনামূলক ৮৯ হাজার ৭৫৪ টন ডাল বেশি আমদানি হয়েছে। আর গেল ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ছোলা আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৩ হাজার ৪৭৬ টন। তার আগের ৬ মাসে ছিল ৬৭ হাজার ৬৪০ টন। ছোলা আমদানি ১৪ হাজার ১৬৪ টন কমেছে। তাছাড়া ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৬৬৩ টন এবং আগের বছরে একই সময়ে আমদানি হয় ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৩ টন। সেক্ষেত্রে ৩৭ হাজার ৩৭০ টন বেশি আমদানি হয়।
তাছাড়া আসন্ন রোজার আগে এবং রোজার মধ্যে নিম্নআয়ের এক কোটি মানুষের মধ্যে তিন দফায় কম মূল্যে পণ্য বিক্রির কর্মসূচি চূড়ান্ত করেছে টিসিবি। এর মধ্যে ৫-২০ মার্চ পর্যন্ত প্রথম দফা, ১৫-৩১ মার্চ পর্যন্ত দ্বিতীয় এবং ১-১৫ এপ্রিল পর্যন্ত শেষ দফা রোজার পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এদিকে নিত্যপণ্যের বাজারে অতি মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জানান,পণ্যের সংকট সৃষ্টির জন্য প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
কোনো কালো হাতকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। সরকারকে এখানে শক্ত হাতে রেফারির ভূমিকা ভালোভাবে পালন করতে হবে। অন্যদিকে এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান জানান, বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। এবার রমজানে যে বাজারে মূল্য কারসাজি হবে আগে ওই বাজার কমিটিকে বিলুপ্ত করা হবে। বাজার কমিটি সঠিক ভূমিকা পালন করলে সংশ্লিষ্ট বাজারে কোনো ব্যবসায়ী মূল্য কারসাজি করতে সাহস পাবে না।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব (সিনিয়র) তপন কান্তি ঘোষ জানান, রোজায় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে। সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতিরও একটা নিয়ম-কানুন আছে। ফলে যারা সে নিয়ম-কানুন মানতে চাইবেন না তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে। সরকার সহজে ব্যবসায়ীদের ওপর হস্তক্ষেপ করতে চায় না। যতটুকু মুনাফা করা দরকার ব্যবসায়ীরা সেটি করলে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না। তবে বাজারে প্রতিযোগিতা নষ্ট হচ্ছে কিনা সেটিও দেখা হবে। কেউ যেন মুনাফার ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন না করে তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে।