আমার প্রিয় বাবা,
বাবা প্রণাম জানাচ্ছি তোমাকে বহু আলোক র্বষ দূরের পথ থেকে। যে দূরত্ব কখনো আমি অতিক্রম করতে পারবোনা জানি। কিন্তু তবুও তোমাকে লিখার লোভ সম্বরণ করতে পারছিনা। কারণ অনেক যন্ত্রণায় আমার মধ্যে শুধু ক্ষরণ হচ্ছে। আমি কাকে সেই কথা বলবো। তুমি যখন চলে গেছো তোমার অস্পষ্ট চলে যাওয়ার দৃশ্যপটও আমার মনে নেই। তোমার মুখাবয়ব কেবলই ধোঁয়ার মতো আমার মানস পটে জেগে আছে। তোমার আত্নত্যাগ আমার মতো হাজার হাজার পিতৃ হারা সন্তানকে উজ্জীবীত করে। তোমার আত্নত্যাগের সোনালী ফসল আজ সমস্ত বাংলাদেশের মানুষকে দান করেছে জীবনী শক্তি। আমার শিশু সময়ের কষ্টটা কখনো কখনো কষ্টের শিশির হয়ে ঝরে পড়েনা। যখোন দেখি জাতির পিতার আত্নত্যাগের যন্ত্রনা বুকে নিয়ে তার কন্যা মাননীয় প্রাধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার আর্দশিত পথে বীরদর্পে এগিয়ে চলেছেন ৭১এর যুদ্ধাপরাধী সেই সব নরঘাতকদের বিচার হচ্ছে এ মাটিতে।
বাবা, শৈশব স্মৃতিতে তোমার স্নেহ আমাকে এখনো আবেগ তাড়িত করে। আমাকে নিয়ে যায় নষ্টালজিয়ায়। তোমার চির অদৃশ্য পটে চলে যাওয়ার পর আমি শ্যাওলার মতো শুধু ভেসে বেড়িয়েছি। বার বার হয়েছি স্নেহের কাঙাল। কোন পিতা যখোন তার ঘরের শীতল ছায়ায় তার সন্তানকে আদর করছে; দূর থেকে তাকিয়ে শুধু দেখছি। অশ্রুর পরসায় আমার দু’চোখ আচ্ছন্ন হয়েছে। ভিখারির মত শুধু মনে মনে তোমাকে ডেকেছি, বাবা তুমি ফিরে এসো ফিরে এসো। গভীর রাত্রির মেঘ মুক্ত আকাশের অন্ধকারে চকচকে তারার মেলায় তোমাকে খুঁজেছি বার বার। আমার বুকের মধ্যে অসম্ভব ক্রন্দনের রোলকে চেপে রেখেছি অনেক কষ্টে। সেই অবদমনের ফল্গু ধারা কেউ কোন দিন দেখেনি। তোমার চলে যাওয়ার পর মাকেও হারিয়েছি দিক চিহ্নহীন পথে। বাবা তোমাকে যারা হত্যা করেছে তারা বিজয় দর্পে হেসেছে। কিন্তু আমি তো জানি তুমিতো এ দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছো । তোমার লুহর প্রতিটি কনা বৃথা যায়নি। আমি হয়তো নাম গোত্র পরিচয়হীন হয়েছি। পেয়েছি কাছের মানুষের ধিক্কার ও অবহেলা। বাবা জানোতো মানুষ কাছের মানুষের অবহেলায় বেশি কষ্ট পায়।
তিল তিল করে গড়ে তোলা তোমার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান আজ বেড়ে বেড়ে ছোট চারা গাছ থেকে মহীরুহ। শুধু সেখানে তোমার নাম কেউ জানেনা। উচ্চারণ করেনা মনের ভুলেও। তোমার নামে নেই কোন মনুমেন্ট, রচিত হয়নি কোন ত্রপিটাপ। অথচ তুমি মিশে আছো এ দেশের শ্যামল মাটিতে, এ দেশের স্বাধীনতায় । বিজয় দিবসে, স্বাধীনতা দিবসের আনুষ্ঠানিকতায় ফুলে ফুলে ভরে যায় দেশ। শুধু তোমার আত্নত্যাগের দিনটিকে আমরা স্মরণ করতে পারিনা। আমার ব্যার্থতার যন্ত্রণায় নিজেই কুড়ে কুড়ে মরি। ভাবি ঈশ্বর আমাকে এমনি করে কষ্ট পাওয়ার জন্যই হয়তো পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। না হলে পিতা মাতাকে শৈশবে হারাবো কেন?
বাবা, তোমার একনিষ্ঠতা, মেধা ও শ্রম দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলে ছিলে। তোমার মানবতা বোধ আর্দশ এখনো অনেক প্রবীনগণ স্মরণ করেন। মানুষের প্রতি অপার ভালবাসা, ভেদাভেদহীনতা তুমি মহামন্ত্র রূপে গ্রহণ করেছিলে। সেই আর্দশের রূপকার ছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র। তার প্রতিষ্ঠিত সৎসঙ্গের তুমি ছিলে ধারক, বাহক ও সৎসঙ্গ সংবাদের পৃষ্ঠপোষক। কত বড় সংসারের ঘানী টেনেও তুমি হাসি মুখে প্রতিষ্ঠিত করেছো এই সৎসঙ্গ আশ্রম। বিত্তে বৈভবে তা বেড়েছে আকাশ চুম্বি হয়ে। শুধু মানবতার বানী যেন কেঁদে মরছে নিরবে নিভৃতে। মানুষের বিলাসী জীবনের আড়ালে কেঁদেছেন ঠাকুর।
সেই ১৯৭১ সালের ৮ই আগষ্ট যেদিন পাকিস্তানী সৈন্য আর আলবদর,আলসামছরা তোমার বুকের উপর গুলি চালিয়ে বুক ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। বুক থেকে ফিনকী দিয়ে রক্ত ছুট ছিল। সে দিনও তুমি অকুতো ভয়ে প্রতিবাদী হয়ে শহীদ হয়েছিলে। বহুদূর থেকে বয়ে আনা শ্রীশ্রীঠাকুরের পাদুকা তোমার রক্তে রক্তাক্ত হয়ে ছিল। তুমি চীৎকার করে বলেছিলে ‘জয় বাংলা’।
তোমাকে হত্যা করে ওরা জলপাই রঙের কনভয় চালিয়ে কালো ধোয়া উড়িয়ে চলে গিয়ে ছিল।
তোমার শহীদী দেহের সৎকার করার জন্য কোন লোক ছিল না। আমিতো অবোধ শিশু ছিলাম। কে কোথায় আমাকে লুকিয়ে রেখেছিল মনে নেই। তারপর তো আমার দুঃখের স্রোতের মধ্যে শুধু ভেসে চলা। নামহীন,গোত্রহীন ও পরিচয় হীন এক মুক্তিযুদ্দে শহীদের সন্তান।
বাবা, আমার হয়তো একটু অস্পষ্ট সন্ধ্যার আলোকের মতো তোমার কথা কিছুটা মনে আছে। কিন্তু সেই সময়ের অবুঝ শিশুটির কথা কি তোমার মনে আছে? কারণ সেই মহা বিপর্যয়ে আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। এই জগত সংসারে শুধু অবহেলায় অবহেলায় ভেসে চলেছি। বৃক্ষ ভেবে গাছের যে ডালই ধরতে গেছি সে ডালই ভেঙে পড়েছে। কারণ বাবা ছাড়া আর কেউই যে তার সন্তানকে ভালবাসতে পারেনা।
এখনো অনূকার রাত্রির তারা খচিত আকাশে তাকিয়ে তোমাকে খুজি যে বাবা। ইচ্ছা হয় চীৎকার করে ডাকি- বাবা তুমি ফিরে এসো।
ইতি,তোমার নটো কিশোর আদিত্য