গাইবান্ধা সদরে তহসিলদারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ
মোঃ মোনায়েম হোসেন মন্ডল:
গাইবান্ধা সদরে তহসিলদার কর্তৃক ভুমি মালিকদের হয়রানি সহ ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দেখার কেউ নেই!
গাইবান্ধা সদর উপজেলার এসি ল্যান্ড অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আঁতাত করে বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তফশিলদাররা ভুমি উন্নয়ন কর আদায়ে ফাঁকি,বিভিন্ন অজুহাতে অফিস ফাঁকি,কৌশলে ভুমি মালিকদের হয়রানি সহ ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গাইবান্ধা শহরের আদর্শপাড়া এলাকায় সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ২শ কোটি টাকা মূল্যের ৬০ বিঘা মালিক বিহীন জমির একটি ফাইল রহস্যজনক কারণে দীর্ঘ ১২ বছর থেকে গাইবান্ধা সদরের এসি ল্যান্ড অফিসের লাল ফিতায় বন্দি হয়ে রয়েছে! কিন্তু দেখার কেউ নেই!
অভিযোগে জানা যায়, গাইবান্ধা সদর উপজেলার বল্লমঝাড়, থানসিংহপুর, খোলাহাটী ইউনিয়ন তহশিল অফিসের আওতাভুক্ত অধিকাংশ এলাকা গাইবান্ধা শহরের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং নদী বিধৌত চরাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন তহশিল অফিস সমূহ থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। তহশিলদাররা গাইবান্ধা শহর ঘেঁষা এই তিনটি ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে অবৈধভাবে আয়ের উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতা মূলক ভাবে বদলি হয়ে আসেন।
এদিকে, যে তহসিলদারই বদলি হয়ে আসেন, তিনি কয়েক দিনের মধ্যে দালাল নিয়োগ সহ এলাকায় গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। এই দালাল এবং সিন্ডিকেট এর মাধ্যমে তারা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সরকারি খাসজমি ব্যক্তি মালিকানায় নামজারি করে দেয়া সহ প্রায় প্রতিটি তহশিল অফিসে চুক্তিতে বা নিজের মনগড়া ভাবে খাজনা আদায়ের জন্য দাখিলা/খাজনা রসিদ প্রদান করে থাকেন। ফলে সরকার প্রতি বছর প্রায় প্রতিটি তহশিল অফিস থেকেই আর্থিক ভাবে কোটি কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যা তহশিল অফিস সমূহ থেকে খাজনা আদায়কৃত রসিদের সুত্র ধরে সংশ্লিষ্ট জমি সরেজমিনে যাচাই করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে ।
শুধু তাই নয়,তহশিলদাররা অবৈধভাবে আয়ের উদ্দেশ্যে নামজারির কেস প্রতি ৪/৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে। ভুক্তভোগীদের এই ধরনের অভিযোগ প্রচুর রয়েছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই! ১৪২২ বাংলা সালে সরকার ভূমি উন্নয়ন করের রেট যুগোপযোগী ভাবে বৃদ্ধি করায় দেখা যায়, ২৫ বিঘার নিচের ভুমির মালিকের কাছে থেকে মওকুফের দাখিলা দুই টাকার স্থলে ১০ টাকা, আবাসিক (কাঁচা) ৫ টাকার স্থলে ১০ টাকা, বিল্ডিং সাত টাকার স্থলে ২০ টাকা, গ্রামে বাণিজ্যিক ১৫ টাকার স্থলে ৪০ টাকা আর পৌর এলাকায় বাণিজ্যিক ২২ টাকার স্থলে ৫০ টাকা এবং বিভাগীয় শহরে রেট আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে তহশিলদাররা বর্তমান রেট অনুসারে ডিম্যান্ড তৈরি না করে আগের পুরাতন রেটে বাৎসরিক মনগড়াভাবে ডিমান্ড লিখে দাখিল করে থাকে, যাতে তারা নিজেরা চুক্তিতে বা মনগড়া ভাবে খাজনা আদায়ের রসিদ প্রদান করে লাভবান হতে পারে,সেই কৌশল তৈরি করে রাখে। এ ব্যাপারে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট তহসিলদাররা ভুমি মালিকদের কাছে প্রথমে বর্তমান রেটে হিসাব করে বড় এমাউন্ট ধরিয়ে দেয়, পরে সমঝোতার মাধ্যমে চুক্তিতে পূর্বের রেটে বা জমির আকার পরিবর্তন করে খাজনার রসিদ কেটে দেয়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করায় তহশিলদাররা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জিরো থেকে হিরো হয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক তহসিলদার তাদের দেয়া স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব বিবরণীর অতিরিক্ত হিসাবের বাইরে ধরা পড়ার ভয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী, শ্যালক, শ্বশুর-শাশুড়ি বা বিভিন্ন নিকটাত্মীয়ের নামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কিনছে। এমনকি অনেক তহসিলদার তাদের ছেলে মেয়েদেরকে অনেক ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখা পড়া করাচ্ছে, তার মাসিক বেতন বা আয়ের সাথে ব্যয়ের হিসাব মিলালেই বেড়িয়ে আসবে থলের বিড়ালের ন্যায় তাদের দূর্নীতির নাতিদীর্ঘ খতিয়ান।
সুত্র জানায়, তহশিলদার আবুল হোসেন চরাঞ্চল বেষ্টিত কামারজানি ও দারিয়াপুর তহসিল অফিসের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নদী ও রাস্তার জমি ব্যক্তি মালিকানায় নামজারি করে দেয়া সহ বিভিন্ন ভাবে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিষয়টি সম্প্রতি গাইবান্ধা সদরের এসি ল্যান্ড(তৎকালীন) নাহিদুর রহমান সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে রহস্যজনক কারণে আইওয়াশ হিসেবে তাকে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাখালবুরুজ ইউনিয়ন ভূমি অফিসে বদলি করেন। উক্ত তহসিলদার আবুল হোসেন ইতোমধ্যে গাইবান্ধা শহরের গোবিন্দপুর মৌজায় জমি কিনে বিলাস বহুল বাড়ি বানিয়েছেন। জমি ক্রয়সহ বাড়ি তৈরির খরচ আনুমানিক ৫০ লক্ষাধিক টাকার উপরে হতে পারে! প্রায় প্রতিটি তহশিলদারের চাকরিতে যোগদানের সময়ের আর্থিক অবস্থান এবং বর্তমান আর্থিক অবস্থান যাচাই করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে!
সূত্র আরও জানায়, বল্লমঝাড় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহসিলদার আতিকুর রহমান আতিক জহুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে দালাল নিয়োগ দিয়েছে। সে নিজে ও এই দালালের মাধ্যমে প্রতিটি নামজারির কেস ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। তহশিলদার আতিকুর রহমান আতিক টেঙ্গরজানী মৌজায় মৃত রমজান আলীর পুত্র রফিকুল ইসলামকে ৩২ শতাংশ জমি সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা থাকা অবস্থায় মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে গোপনে নামজারি করে দেয়। রফিকুল ইসলাম উল্লেখিত ৩২ শতাংশ জমির নামজারির জন্য আবেদন করেন, যার নম্বর ২১৬/১৯-২০। প্রথমে এই ফাইলটির প্রস্তাবনা না দেয়ায় ১৫/০৩/২০২০ ইং তারিখে তা নথিযাত হয়। কয়েক মাস পর পুনরায় এই ফাইলটি নামজারির জন্য আবেদন করেন, যার নং ৪২২/২০-২১। খোঁজ পেয়ে মজিবর রহমানের পুত্র মকসুদ আলী ৬/৯/২০২০ ইং তারিখে গাইবান্ধা সদরের এসিল্যান্ড বরাবর উল্লেখিত জমির মামলা সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বলে আপত্তি জানালে গত ২১/০৯/২০২০ ইং তারিখে ওই ফাইলটিও নথিযাত করা হয়। কিন্তু এবার ওই ফাইলের আবেদনকারী রফিকুল ইসলাম তহশিলদার আতিকুর রহমানের সাথে তৃতীয় দফায় মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে পুনরায় আবেদন করেন, যার নং ১৫৮৩/২০-২১। ধুরন্ধর তহসিলদার আতিকুর রহমান সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকা জমির এই আবেদনটি সরেজমিনে তদন্ত না করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে গোপনে প্রস্তাবনা প্রেরণের মাধ্যমে ৩/১২/২০২০ ইং তারিখে নামজারির অনুমোদন দেয়া হয়। এছাড়াও একই এলাকার ময়নুল হক গংকে ভুয়া দলিল সৃজন করে ৫১ শতাংশ জমি নামজারি করে দেয়া হয়। যার অনলাইন আবেদন নং ১৮৬৯২৬৬, তারিখ- ০১/১০/২০২০ এবং সিরিয়াল নং- ৯৯৩/২১-২২ ইং। এই কেসটির বিপরীতে মিস কেস দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। চকগয়েশপুর মৌজায় সাখাওয়াত গং এর দখলে জমি না থাকা সত্ত্বেও আবেদন নং ২৫৫৪/২০-২১ নামজারির ফাইলটি সরেজমিনে তদন্ত না করে গোপনে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এই নামজারির কেসের বিপরীতে শহিদুল ইসলাম নামের এক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি গত ৯/৩/২০২২ ইং তারিখে মিস কেস নং ১০৫ দায়ের করেন। উক্ত মিস কেসটি বিচারাধীন রয়েছে। এই তহশিলদার আতিকুর রহমান আতিক দূর্নীতির কারণে ১২/১১/২০০৬ ইং সালে চাকরি বিধিমালা ৪(৩)(সি) ধারায় চাকরিচ্যুত হয়েছিল। আবারও ভুমি মালিকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে তিন দিনের মধ্যে জবাব চেয়ে গত ৪/৪/২০২২ ইং তারিখে গাইবান্ধা সদর উপজেলার বর্তমান এসি ল্যান্ড তরিকুল ইসলাম কর্তৃক কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। তবে গত ৭/৪/২০২২ ইং তারিখে তহশিলদার আতিকুর এর পক্ষে আয়েশা সিদ্দিকা নোটিশ গ্রহণ করেন। আজ এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো জবাব দেয়া হয়নি।
মজার ব্যাপার হলো- নামজারির মোকদ্দমা নিস্পত্তির পূর্বে আবেদনকারী ও বিবাদী উভয় পক্ষে সরেজমিনে গিয়ে নোটিশ প্রদানের নিয়ম থাকলেও তা না করে শুধু মাত্র কাগজ কলমে নোটিশ জারি করার কারণেই বিরোধপূর্ণ জমির নামজারি অনুমোদন গোপনে করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধুরন্ধর তহসিলদার আতিকুর রহমান একজনের জমি অন্যজনের নামে, দখল নাই এমন জমি নামজারি করে দেয়া, কৌশলে কাগজ পত্রে ত্রুটি ধরে কাগজ পত্র সংশোধন করে নামজারি করে দেয়া, খাজনা আদায়ের বেলায় চুক্তি করা সহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি- নিজের মনগড়া ভাবে অফিসে যাতায়াত করে থাকে। ফলে সেবা নিতে আসা অনেক ব্যক্তি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
নির্ভরশীল সুত্র জানায়, বল্লমঝাড় ও খোলাহাটী তহশিল অফিসের আওতাভুক্ত ২০ বিঘা সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জমি ব্যক্তি মালিকানায় নামজারি করে নিতে জনৈক ব্যক্তিকে এসি ল্যান্ড অফিসের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার সাথে অফিসে গভীর রাতে মাঝে মাঝে বেশ কয়েক দিন দেনদরবার করতে দেখা গেছে বলে নির্ভরশীল জানিয়েছে।
সুতরাং গাইবান্ধার ভুমি অফিসের তফশিলদারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দূর্নীতির কারণে এলাকায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, মামলা মোকদ্দমা, দাঙ্গা হাঙ্গামা, পারিবারিক সহিংসতা, অনর্থক মিস কেসের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়ছে এলাকার ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ। তাই জরুরী ভিত্তিতে দূর্নীতির সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক সহ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকার ভুক্তভোগী ও শান্তি প্রিয় সচেতন জনগণ।